বাংলা ক্যালেন্ডার বঙ্গীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ। বাংলায় নববর্ষ উদযাপন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পার্বণ, পূজা, এবং রীতি-নীতি, সব কিছুই বাংলা ক্যালেন্ডারের উপর নির্ভরশীল। বাংলা ক্যালেন্ডারের মাসের নাম, দিন এবং তিথি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। এই নিবন্ধে আমরা ২০২৫ সালের বাংলা ক্যালেন্ডার নিয়ে বিশদ আলোচনা করব এবং বাংলা ক্যালেন্ডারের গুরুত্বপূর্ণ দিন, পূজা, পার্বণ এবং অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দিবসগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
বাংলা ক্যালেন্ডার: একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলা ক্যালেন্ডার বা বঙ্গাব্দ মূলত সৌর ক্যালেন্ডার। এটি সূর্যচক্রের ভিত্তিতে তৈরি, যেখানে চন্দ্র মাসের পরিবর্তে সৌর মাস ধরে দিন গণনা করা হয়। বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ে, যা তখন মুলত ফসলি বছর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আকবর এই বর্ষপঞ্জি চালু করেন যাতে রাজস্ব আদায় সহজতর হয়। আজও এই ক্যালেন্ডারটি বাংলা অঞ্চলের মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করে।
বাংলা ক্যালেন্ডারের মাসের নাম ও দিন সংখ্যা
বাংলা ক্যালেন্ডার মোট ১২টি মাস নিয়ে গঠিত, যা বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন এবং চৈত্র নামকরণে পরিচিত। প্রতিটি মাসের দিন সংখ্যা ভিন্ন হয়, যা সৌরচক্রের উপর নির্ভর করে। বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রতি বছর ৩৬৫ দিনে বিভক্ত এবং প্রতি চার বছরে একটি অধিবর্ষ (লিপ ইয়ার) হয়, যেখানে একটি দিন বেশি যোগ হয়।
২০২৫ সালের বাংলা ক্যালেন্ডার: মাসিক বিশ্লেষণ
বৈশাখ (১৪ এপ্রিল – ১৪ মে)
বৈশাখ বাংলা বছরের প্রথম মাস। এই মাসে পহেলা বৈশাখ, অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ পালিত হয়, যা বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম বৃহৎ উৎসব। এই দিনে বাঙালি জাতি নববর্ষকে স্বাগত জানায় এবং নতুন বছরের মঙ্গল কামনা করে।
- পহেলা বৈশাখ: ১৪ এপ্রিল, ২০২৫ (বাংলা নববর্ষ)
- শুভ মহররম (ইসলামিক মাস) শুরু: ২৫ এপ্রিল, ২০২৫
জ্যৈষ্ঠ (১৫ মে – ১৪ জুন)
জ্যৈষ্ঠ মাসে গ্রীষ্মকাল তার তীব্রতা লাভ করে, এবং এ সময়টায় ফলের রাজা আম পাকতে শুরু করে। এই মাসে কৃষকদের ব্যস্ততা এবং শিশুদের জন্য আম কাঁচা ও পাকা খাওয়ার সময় হয়।
- বিদ্যাসাগর দিবস: ২৬ মে, ২০২৫
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকী: ৮ জুন, ২০২৫
আষাঢ় (১৫ জুন – ১৫ জুলাই)
আষাঢ়ে বর্ষাকাল শুরু হয়, যা বাংলার কৃষি ও প্রকৃতিতে নতুন জীবন দেয়। বর্ষার প্রথম বর্ষণ বাংলার মাটি ও প্রকৃতিকে শীতল করে তোলে।
- রথযাত্রা: ১ জুলাই, ২০২৫
- কাবা দিবস: ৪ জুলাই, ২০২৫
শ্রাবণ (১৬ জুলাই – ১৫ আগস্ট)
শ্রাবণ মাস বর্ষার শ্রেষ্ঠ মাস, এবং এই মাসে সাধারণত গুরুপূর্ণিমা পালিত হয়। শ্রাবণ মাসে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শিবের পূজা করে।
- গুরুপূর্ণিমা: ২২ জুলাই, ২০২৫
- রাখিবন্ধন: ১২ আগস্ট, ২০২৫
ভাদ্র (১৬ আগস্ট – ১৫ সেপ্টেম্বর)
ভাদ্র মাসে বাংলায় শারদীয় উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়। এটি বর্ষার শেষ মাস, এবং বাংলার মাটি খরার থেকে সতেজ হয়।
- জন্মাষ্টমী: ২২ আগস্ট, ২০২৫
- বিশ্বকর্মা পূজা: ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
আশ্বিন (১৬ সেপ্টেম্বর – ১৫ অক্টোবর)
বাংলার আশ্বিন মাস শারদীয় উৎসবের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্গা পূজার মাধ্যমে এই মাসে বাঙালি তার সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যায় এবং আনন্দে মেতে ওঠে।
- মহালয়া: ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
- দুর্গাষ্টমী: ৫ অক্টোবর, ২০২৫
কার্তিক (১৬ অক্টোবর – ১৪ নভেম্বর)
দুর্গাপূজার পরেই কার্তিক মাস শুরু হয় এবং দীপাবলি ও কালীপূজা এই মাসে পালিত হয়।
- দীপাবলি: ১ নভেম্বর, ২০২৫
- ভাইফোঁটা: ২ নভেম্বর, ২০২৫
অগ্রহায়ণ (১৫ নভেম্বর – ১৪ ডিসেম্বর)
অগ্রহায়ণ মূলত কৃষকদের ফসল কাটার মাস। বাংলার কৃষি প্রধান সমাজে এই মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- নবমীর পরের সপ্তাহ: ধন্যা উৎসব
- ধান কাটার সময়: ২৫ নভেম্বর, ২০২৫
পৌষ (১৫ ডিসেম্বর – ১৪ জানুয়ারি)
পৌষ মাসে শীতকালের সূচনা হয়। পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি এই মাসের প্রধান উৎসব।
- মকর সংক্রান্তি: ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫
মাঘ (১৫ জানুয়ারি – ১৪ ফেব্রুয়ারি)
মাঘ মাসে শীতকাল তীব্রভাবে অনুভূত হয় এবং এই মাসে পৌষ পার্বণ বা ভাত কুম্ভ ও পিঠে-পুলির উৎসব শুরু হয়।
- সরস্বতী পূজা: ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ফাল্গুন (১৫ ফেব্রুয়ারি – ১৫ মার্চ)
ফাল্গুন বসন্তের প্রথম মাস এবং বাঙালির প্রাণের উৎসব, হোলি বা দোলযাত্রা এই মাসে পালিত হয়।
- দোলযাত্রা: ১৩ মার্চ, ২০২৫
চৈত্র (১৬ মার্চ – ১৩ এপ্রিল)
চৈত্র মাস বাংলা বছরের শেষ মাস এবং চৈত্র সংক্রান্তির মাধ্যমে বাংলা নতুন বছরকে বরণ করার প্রস্তুতি শুরু হয়।
- চৈত্র সংক্রান্তি: ১৩ এপ্রিল, ২০২৫
বাংলা ক্যালেন্ডারের বিশেষ দিনগুলি
বাংলা ক্যালেন্ডারের বিশেষ দিনগুলো বাঙালির আবেগ, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এক অপরিহার্য অংশ। এই দিনগুলো শুধু উৎসবের উপলক্ষই নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন উৎসব বাঙালির জীবনকে রঙিন করে তোলে এবং পারস্পরিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের বন্ধনকে আরও মজবুত করে।
পহেলা বৈশাখ:
বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালির জাতিগত ঐক্যের প্রতীক। এই দিনটি উদযাপন করতে গ্রাম থেকে শহর, সকল মানুষ নতুন কাপড় পরে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়, যা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ব্যবসায়ীরা নতুন হিসাবের খাতা খোলে, যা ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত। এই দিনটি বাংলার লোকজ সংস্কৃতির সেরা উদাহরণ।
রথযাত্রা ও দোলযাত্রা:
বাংলা ক্যালেন্ডারের আষাঢ় মাসে রথযাত্রা পালিত হয়। এই উৎসবে রথে করে দেবতা জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা বের করা হয়। হাজার হাজার ভক্ত এই শোভাযাত্রায় অংশ নেয়, এবং ভক্তিমূলক গান গেয়ে এই উৎসব উদযাপন করে। ফাল্গুন মাসে অনুষ্ঠিত হয় দোলযাত্রা বা হোলি, যা বর্ণময় উৎসব হিসেবে পরিচিত। ভক্তিভাব ও আনন্দের মিশেলে এই উৎসব বাঙালির মনে এক বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে। দোলযাত্রার দিন রাধাকৃষ্ণের পূজা করা হয়, এবং রঙের খেলা খেলা হয়, যা পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও বন্ধুত্বকে আরও গভীর করে।
দুর্গা পূজা:
বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বড় উৎসব দুর্গা পূজা। এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয়া উৎসব হিসেবে পরিচিত এবং পাঁচ দিনব্যাপী এই পূজা বাঙালির জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আশ্বিন মাসে পালিত এই উৎসব মা দুর্গার প্রতি ভক্তি নিবেদন এবং অসুরের বিরুদ্ধে দেবীর বিজয়ের প্রতীক। মণ্ডপে-মণ্ডপে প্রতিমা দর্শন এবং ধুনুচি নাচ, সিঁদুর খেলা, অঞ্জলি প্রদান এবং প্রসাদ বিতরণ এই উৎসবকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তোলে। দুর্গা পূজা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐক্যেরও প্রতীক।
কালীপূজা ও দীপাবলি:
কালীপূজা বাংলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, যা কার্তিক মাসে পালিত হয়। মাতৃ শক্তির আরাধনা এবং অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা করার উপলক্ষ হিসেবেই এটি উদযাপিত হয়। কালীপূজার সময় মানুষ মণ্ডপে কালী মায়ের পূজা করে এবং আতশবাজি ফোটায়। দীপাবলির রাতে প্রদীপ জ্বালানো হয়, যা অন্ধকারকে দূর করে আলোর বার্তা দেয়। এই দিনে মানুষ ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে এবং সেজে ওঠে। কালীপূজা ও দীপাবলি দুইটাই বাঙালির জীবনে আধ্যাত্মিকতার এক আলাদা অর্থ বহন করে।
নবমী ও ধন্যা উৎসব:
বাংলা ক্যালেন্ডারের অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার পর শুরু হয় ধন্যা উৎসব। এই উৎসব মূলত বাংলার কৃষিজীবী সমাজে প্রচলিত। বাংলার কৃষকেরা এই উৎসবের মাধ্যমে প্রকৃতি এবং মাটি মাতাকে শ্রদ্ধা জানায়, যা তাদের জীবিকার মূল উৎস। এটি কৃষকদের জন্য এক ধরনের কৃতজ্ঞতার উৎসব, যেখানে তারা ভালো ফলনের জন্য ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
বাংলা ক্যালেন্ডারের গুরুত্ব ও বাঙালির জীবনধারা
বাংলা ক্যালেন্ডার কেবল দিন, মাস বা উৎসবের তালিকা নয়, এটি বাঙালির আবেগ, অনুভূতি এবং ঐতিহ্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বছরের শুরুতে পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে চৈত্র সংক্রান্তি পর্যন্ত বাংলার প্রতিটি পর্ব বাঙালির জীবনে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে। কৃষি ঋতু, পারিবারিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় উৎসব এবং সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান সবই বাংলা ক্যালেন্ডারের উপর নির্ভরশীল। এই ক্যালেন্ডার বাঙালির জীবনের আনন্দ এবং সংগ্রামের সাক্ষী, যা তাদের প্রতিদিনের জীবনকে সমৃদ্ধ এবং প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
২০২৫ সালের বাংলা ক্যালেন্ডারের বিশেষ দিনগুলি বাঙালির সমাজে সংস্কৃতির সেরা প্রকাশ ঘটায় এবং পারস্পরিক মমত্ববোধকে আরও দৃঢ় করে তোলে।